শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২, ১১:১৮ পূর্বাহ্ন
জাকারিয়া কাজী
দলীয় কোন্দল যেন প্রায় প্রতিটি দলের এক ভয়ানক বিষফোড়াঁ–যার রোষানলে পড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন আকিব নামের এক শিক্ষার্থী। দলীয় কোন্দলের ইতিহাস অনেক বড়। দলীয় কোন্দলে পর্যুদস্ত হয়ে কেউ নুতন দলে যান,কেউ নুতন দল করেন,আবার কেউ দলে ভিড়তে যৌবনহারা বাঘের গর্জন করেন,কেউ আস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হন,তবে তারুণ্যের অনেকেই জীবন মৃত্যুর খেলায় পর্যুদস্ত হন। আকিবও নাকি নওফেল-নাসিরেরই কোন্দলের শিকার।তৃণমূল পর্যায়ের পক্ষপাতমুলক আচরনের কারনে নাকি শিক্ষার্থী আকিবের এমন করুন দশা।
নওফেলের বাবা চট্টলবীর মহিউদ্দীন চৌধুরীর সাথেও কোন্দলে জড়িয়েছিলেন আ জ ম নাছির। যুবসমাজের মধ্যে গ্রহনযোগ্যতা থাকলেও মহিউদ্দীন চৌধুরীর শক্ত ভিত্তির কারনে আশানুরূপ সফলতা পাননি নাসির।প্রয়াত মহিউদ্দীন তনয় নওফেল এখন মন্ত্রী। মহিউদ্দীন প্রেমীরা নওফেলকে নিয়ে চট্টগ্রামকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে বলে সেই পুরানো বিরোধ আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে বলে অনেকের ধারনা।
তৃণমূলের নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর সাথে ধনকুবের আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বিরোধের মধ্য দিয়েই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে শুরু হয়েছিল বিভাজনের রাজনীতি। তাদের কোন্দলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দল,বাধাগ্রস্ত হয়েছিল দলীয় কর্মসূচি।এবং এই অপরাজনীতির কারনেই চট্টগ্রামে মাথা তুলে দাড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল বিএনপি। জীবিত বাবু-মহিউদ্দীনরা মন্ত্রীত্বের স্বাদ কেন পাননি–সে প্রশ্নে যেতে রাজি নই,তবে জাঁদরেল দুই নেতার সন্তান নওফেল ও জাভেদকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা অস্হির চট্টগ্রামে স্বস্হি ফিরিয়েছেন।প্রয়াত দুই নেতাকেও প্রকারান্তরে সম্মানিত করেছেন নেত্রী। তারাও কাধেঁ কাধঁ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও নাকি সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মান নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আগুনে খেলা খেলে যাচ্ছে আওয়ামী লীগেরই অদৃশ্য অংশ–যে আগুনে ঘি ঢালতে এক পায়ে দাড়িয়ে আছেন সরকার বিরোধী চক্র।
বিএনপি দলীয় চরিত্রও ছিল একই বৃত্তে। বিভাজনের রাজনীতি এখানেও তাদেরকে দাড়াতে দেয়নি। ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ আর জামালউদ্দীন আহমদের মধ্যকার চট্টগ্রাম বিএনপির বিরোধ এতই প্রকট ছিল যে,সুলতান সমর্থকদের দাপটে বিমান থেকে নামতেই পারেননি ব্যারিস্টার জামাল উদ্দীন। সুলতান সমর্থকদের পাথরবৃষ্টিতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিমানের জানালা। সেই বিরোধের ঢেউ আচড়েে পড়েছিল সেনানিবাসে, সেনাদের মাঝে। জাতীয়তাবাদী দলের সেই বিরোধের ধারাবাহিকতা ছাই চাপা আগুনের মত এখনো আছে।এই অদৃশ্য বিরোধের কারনেই দলীয় মেয়র প্রার্থীরা কখনো উঠেছে,আবার কখনো নেমেছে।টানা হেঁচড়ায় যাঁতাকলে পড়ে আওয়ামী ঘরানার অভিমানী মেয়রপ্রার্থী ( বিএনপি)মন্জুর আলমও নেতৃত্বশূন্য বিএনপি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
দলীয় কোন্দলের মাঝে “লোভ” পরাক্রমশালী হলেই মানুষ মনুষ্যত্ব হারায়। মনুষ্যত্ব হারিয়েছিল প্রথম সারির আওয়ামী নেতা খোন্দকার মোশতাক।দলীয় চার নেতার উপর বঙ্গবন্ধুর অতিমাত্রিক নির্ভরতাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি তিনি। ক্ষমতার সিড়ি খুজঁতেই হাত মিলিয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে।গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে ভাগিনা কর্নেল ফারুক ও তার ভায়রা কর্নেল রশীদকে হাত করে পাঠিয়েছিলেন জিয়ার দরবারে। খালেদাকে গ্রহনে বাধ্য করা বঙ্গবন্ধুর সেই চাপের কথা স্মরন করে প্রতিশোধের নেশায় ফারুক-রশীদদের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন জিয়া। রচিত হলো বঙ্গবন্ধু হত্যার নির্মম ইতিহাস।সেনাদের মাথায় রক্ত উঠলে নাকি ‘লাশ আর লাশ থাকেনা।’ কিন্তু জনক বলে কথা। নিহত বঙ্গবন্ধুকে তারা হেলিকপ্টারে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। সাবান পানি দিয়ে পরিশোধিত হয়ে মা-বাবার কবরের পাশে শায়িত হয়েছিলেন নেতা। তার পরিবারও গোসল-কবর সব পেয়েছিলেন।
জাতীয়তাবাদী দলের জামাল-সুলতান গ্রুপের(চট্টগ্রাম) কোন্দলের ঢেউ সেনানিবাসে আঘাত করায় জেনারেল জিয়াও বাচঁতে পারেননি।সেনানিবাসের বিরোধ মিটিয়ে সার্কিট হাউসে আসতে না আসতেই ঘাতকের দল তাকে অনুসরন করে,সার্কিট হাউসে এসে শুধুমাত্র জিয়াকেই ক্ষতবিক্ষত করে। বঙ্গবন্ধু সাবান-পানির গোসল পেলেও জেনারেল জিয়া সে সুযোগ থেকে বন্চিত হন। সারাদিন খুঁজেও পাওয়া যায়নি তার লাশ। খোন্দকার মোশতাক পাগলামি করতে করতেই মরেছিল। তার সন্তনেরা বাবার জানাজা পড়েনি,কবরে জমেছিল জুতার স্তুুপ। আর জামাল-সুলতানকে বহিস্কৃত করেছিলো জাতীয়তাবাদী দল।তাদের রাজনীতির করুণ অপমৃত্যু দেখেছে দেশবাসী।চেষ্টাকরেও তারা আর দাড়াতে পারেনি।জনগন কতৃক প্রত্যাখ্যিত্য হলে নেতা কিংবা দল—কারো পক্ষে কোমর সোজা করে দাড়ানোর আর সুযোগ থাকেনা।
বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়াকে হারিয়েও আমরা শিক্ষা লাভ করতে পারিনি। এখনও দলীয় কোন্দল কিংবা জিঘাংসায় এখনো ঝরছে প্রান।পঙ্গুত্ব বরন করছে কেউ কেউ। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে অনেক পরিবারের স্বপ্ন,আশা ভরশা।
মুজিব-জিয়ার করুণ মৃত্যুর পর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের শ্রদ্বাবোধ একেবারেই কমে গেছে। নামসর্বস্ব দলগুলোর নেতারা যতই গলাবাজি করছে,জনগন ততই তাদের নিয়ে হাসি তামাশা করছে। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জনগনের অংশগ্রহণ একেবারেই কমে গেছে। নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন,মনে হয় জনগনের অংশগ্রহণ দিন দিন আরো কমতেই থাকবে। তারা আন্দোলন আন্দোলন খেলার চেয়ে কাজ করে খেতে চায়।এবং সে পথেই হাটঁছে যুবসমাজ।
পাড়া,মহল্লা,উপজেলা,জেলা,বিভাগীয় বিভাজনগুলোকে এখনই আমলে নেয়া প্রয়োজন।নইলে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরাও অলসতায় নিমজ্জিত হবে সহসা।দল নিয়ে দলবাজি নয়,গলাবাজিও নয়। ব্যক্তিগত ব্যবসা কিংবা বানিজ্যকরনের স্বার্থেই নাকি দলের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই নাকি বিরোধ বিরোধ মিটাতে আগ্রহী নন। দলকে জনদলে পরিনত করতে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের গ্রহনযোগ্যতা আরো হারাবে।চার নেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্বা।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Leave a Reply