শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২, ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন
টরেন্টো থেকে মারুফ শাহ চৌধুরী
যেভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক চেতনা ছোট চারা গাছটি ৫০ বছরে বটবৃক্ষ হয়ে গেল। তার সামাজিক এবং ঐতিহাসিক পটভূমি। এই প্রসঙ্গে আলোচনার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। অর্থাৎ ভারতবর্ষে দুটি জাতি হিন্দু এবং মুসলমান। যদিও পাক-ভারত 700 বছর মোগল পাঠান বিভিন্ন মুসলিম শাসক রাজত্ব করে আসছিল এই দীর্ঘ সময়ে হিন্দু সম্প্রদায় কোন সময় ভাবি নি তারা একটি পৃথক সত্তা। তবে এই দেশে যারা রাজত্ব করেছেন বিশেষ করে মোগল পাঠান তারা চেষ্টা করছেন হিন্দুদের সাথে মিলেমিশে থাকার জন্য। সেজন্য মোগল হারামে দাস-দাসী এবং বেগম সাহেবা মধ্যে রাজপুত্ রমণী যোধবাঈ এবং মেহেরুন্নেসা পাশাপাশি অবস্থান পাওয়া যায় এবং সেনাপতি শায়েস্তা খান । রাজপুত মানসিংহ আরো অনেকে ছিল। পাঠান মুলুকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হিমুর সাথে মুসলিম সৈন্য যোগ দেয়। তারপর পলাশীর যুদ্ধ যখন হয় তখন মীরমদন এবং হিন্দু মোহনলাল দেশের স্বাধীনতার জন্য একসাথে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয় শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষ হয়ে।রচিত হয় অক্ষয় কুমার মৈত্র এবং নবীন সেন পলাশী এবং পলাশীর যুদ্ধের মহাকাব্য নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ এদের যৌথ উদ্যোগে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটক এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থ সমূহ। এই সমস্ত বই নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের স্বাধীন সত্তা হিসাবে চিত্রিত করা হয়ে গেছে। পলাশী যুদ্ধের একশত বছর পর প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সিপাহী বিপ্লব শুরু হয়। সেখানে বিদ্রোহের সূচনা ছিল এনফিল্ড রাইফেল যার উপাদান শুকুর এবং গরুর চর্বি যা দাঁতদিয়ে খুলে বারুদ ভর্তি করতে হতো। এখন যেমন ফেসবুক দাঙ্গার উপাদান সেসময় শুকুর এবং গরুর এই দুইটি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সংবেদনশীল এবং তা নিয়ে দাঙ্গার উৎপত্তি শুরু হয়।
পরবর্তী কালে বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটানোর পিছনে এই নবাব সিরাজদুল্লাহ নাটকের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিরাজউদ্দৌলা যাত্রা উভয়ই বাংলায় হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ ভারতে প্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় যদিও তার প্রধান এবং প্রতিষ্ঠিতা ছিল একজন ইংরেজ। পাঠান এবং মোগলরাযতদিন ভারতের শাসক ছিল তখন রাষ্ট্রের ভাষা ছিল ফারসি। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় ফরাসি জানতো এবং ব্রিটিশ ভারতের কিছুকাল আদালতে ফরাসি ভাষার প্রচলন ছিল। রবীন্দ্রনাথের একটি ছোট গল্প মামলার ফল ফরাসি এবং ইংরেজী ভাষার উপর আদালতের ঘটনা নিয়ে বর্ণনা আছে। পরে রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি হলে এটা বিদেশি ইংরেজদের ভাষা এটা শিক্ষা মুসলমানদের অন্যায় এবং এখানে মুসলমানদের অবস্থান দারুল হরব ঘোষণা যেখানে জুমার নামাজ পড়া যাবে না ইত্যাদি কারণেজালাল উদ্দিন আফগানি মুসলিম রেনেসাঁ আন্দোলনের ফলেবহু ভারতীয় মুসলমান আফগানিস্তান হিজরত করে। এর মধ্যে শুরু হয় ওয়াহাবি আন্দোলন বিভিন্ন ধর্ম ভিত্তিক আন্দোলন যেখানে মুসলমান পরাজিত হয়। মুসলমানদের দুর্দশার কথা বুঝতে পেরে স্যার সৈয়দ আহমদ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে এবং ব্রিটিশ গভর্নর হান্টার দি ইন্ডিয়ান মুসলমান একটি বই রচনা করে যেখানে মুসলমানদের হিন্দুদের সাথে অর্থনৈতিক এবং শিক্ষার বৈষম্য তুলে ধরে। মুসলমানরা আস্তে আস্তে ইংরেজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ে ঠিক সেই মুহুর্তে শুরু হয় তুরস্কের উসমানিয়া খেলাফত নিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী দুই ভাইয়ের খেলাফত আন্দোলন সেইসাথে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন। ব্রিটিশ ভারত ছাড় আন্দোলন এবং স্বদেশী আন্দোলন আবার স্কুল কলেজ বর্জন শুরু করে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়। এরমধ্যে ক্ষতি হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণ এর পূর্বে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গিয়েছিল এবং অফিস-আদালতে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু মুসলমান দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এইভাবে একটি জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি হয়।পরবর্তীকালে এই অর্থনৈতিক বৈষম্য শ্রেণি বিদ্বেষ রুপ নেয়। এসময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশ নন্দিনীউপন্যাস অনলে ঘৃতাহুতি দেয়। তিনি মুসলমান কে যবন এবং পাঠান সেনাপতি কন্যা আয়েশার প্রেম রাজপুত সাথে এগুলি শিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে আঘাত দেয়যা একটি শ্রেণী বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এর প্রতিবাদে ইসমাইল হোসেন সিরাজী লেখেন রায় নন্দিনী অনল প্রবাহ আরো কিছু উপন্যাস। শেষ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ক্ষয়ক্ষতি জাপানের আগ্রাসন ও নেতাজি সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং স্বদেশী আন্দোলন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন যুগান্তর অনুশীলন সশস্ত্র সংগ্রাম ইংরেজদের এদের অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ মুসলিম মনে আশঙ্কার জন্মেএদেশে আবার হিন্দু শাসকরা জাঁকিয়ে বসবে আর ইংরেজি এই সুযোগটি গ্রহণ করে। নেতাজী সুভাষ বসু অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা নিয়ে কংগ্রেসে থাকতে পারেননি সেই হিসেবে মোহাম্মদআলী জিন্নাহ যাকে হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত উপাধি দিয়েছিল কংগ্রেস নেত্রী সরোজনী নাইডু। একসময় নেতাজি সুভাষ বসুর মতো তাকে কংগ্রেস ছাড়তে হয়। এই সময়ে ইংরেজদের বঙ্গভঙ্গ পূর্ব বাংলার হিন্দু জমিদারের অত্যাচারে নিষ্পেষিতমুসলমানদের মনে আশার সঞ্চার করে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প মহেশ এই জমিদার দের অমানবিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গ কে ভাগ্ ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণাপূর্ব বাংলার মুসলমানরা কিছু আশার বাণী দেখলো কিন্তু স্বদেশী আক্রমণেই ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ থেকে ইংরেজরা দূরে চলে আসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছেন স্বাভাবিক কারণে কারন তাদের জমিদারী পূর্ববঙ্গে থাকলো তারা বাস করত কলিকাতায়। তখনই লন্ডনে বসে চৌধুরী রহমত আলী পাকিস্তান এই শব্দ দিয়ে একটি স্বাধীন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে স্বাধীনরাষ্ট্রের কথা কল্পনা করে যে পাকিস্তানশব্দ গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব বাংলা ছিলনা। তখনই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব নিয়ে আসে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং শুরু হয় চির কলঙ্কিত হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। কলিকাতা পাঞ্জাব উভয় অংশে মনুষ্য সৃষ্টি রক্তাক্ত দাঙ্গা হয়। হাজার হাজার উদ্বাস্তু স্বদেশভূমি ছেড়ে পাকিস্তান এবং ভারতের চলে আসে। বিখ্যাত সাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টো। ভারতীয় লেখক খুশবন্ত সিং। কৃষণ চন্দর এদের লেখনীতে বাংলার দাঙ্গারমর্মস্পর্শী রূপ এবং মানবতার ক্রন্দন পাওয়া যায়। দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষ রোপণ করা হয়। তারপরও ভারতের মুসলমানদের রক্ষায় হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী ভারতের থেকে যান সেখানকার মুসলমানদের রক্ষা য়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এর আপস ফর্মুলা জিন্না দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এবং কংগ্রেসের সম্মতিতে ভারত বিভক্ত হয় রেডক্লিফ রোয়াদের ভিত্তিতেবাংলার খন্ডিত অংশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয় এটি পৃথিবীর অদ্ভুত রাষ্ট্র। দুটি অংশের দূরত্ব বারোশো মাইল আর মধ্যখানে ভারত। পাকিস্তানের উভয় অংশের ভাষা কৃষ্টি ভিন্ন বিধায় এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম ও একটি পতাকা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তী অধ্যায় বাকিটুকু লেখা হবে। অপেক্ষা করূন। চলবে
Leave a Reply