শুক্রবার, ২৭ মে ২০২২, ০৯:২২ পূর্বাহ্ন
অঞ্জন রায়
আমি আধা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন হিসেবে বড় হয়ে উঠেছি। ইস্কুল জীবনের বেশি সময়েই নিজের চোখে বাপীকে দেখতে পাই নি, তিনি সেই সময়ে রাজনৈতিক কারনে কারাগারে আটক ছিলেন। মা চাকরী করতেন পাবনার একটি নামকরা ইস্কুলে, তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।
সত্তর দশকের মধ্যভাগ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে বাবা জেলখানায়, মা চাকরীহীন। মা ছুটে বেড়াচ্ছেন বাপীর খোঁজে- কারন তিনি কোন কারাগারে তা আমরা জানতাম না। আমি পড়ি জেলা স্কুলে-দিদিভাই গার্লস স্কুলে। সামনে দূর্গাপুজা, বাকী আর মাত্র চারদিন। পাশের বাড়ীর সবাই নতুন জামা জুতো নিয়ে ব্যাস্ত- আর আমাদের তখনো একটুকরো সুতো জোটেনি। মা আমাদের অভয় দিচ্ছেন তোদের ঠিকই নতুন কাপড় দেবো। আমরা মুখ শুকিয়ে ঘুরছি।
ঠিক সেই সময়েই মা নিচের নিমাইদার কাছে থেকে কয়েকটা টাকা ধার নিলেন- আমরা নিউমার্কেটে গেলাম। দিদিভাইয়ের ফ্রকের কাপড়, আমার সার্টের কাপড় কেনা শেষ। আমরা দুজনে মায়ের হাত ধরে ঝুলে আছি- তোমাকে শাড়ী কিনতে হবে। মা রাজি নন, আমাদের চোখের জল দেখে মা শেষে ঢুকলেন লাকী কর্নারে। ১৫০ টাকার সুতি শাড়ী, বেগুনি জমিনে সাদা ছোপ। আমরা নাম দিলাম বিস্কুট শাড়ী। কারন প্রিন্ট টা বিস্কুটের মতোন।
সুভাস দাদার টেইলার্সে কাপড় শেলাই হচ্ছে- আমরা দু ভাইবোন আনন্দে উড়ছি। পুজোর একদিন বাকী চলে এসেছে নতুন কাপড়। সকালে ঘুম ভাংলো ভট ভট ভট ভট যন্ত্রের শব্দে- অবাক হয়ে দুই ভাইবোন নিচে নামলাম- বাড়ীর পেছনের পুকুর থেকে শব্দ আসছে। দুজনে দৌড়ে গেলাম, দেখলাম ক্রয় সুত্রে পুকুরের ২৫ ভাগের মালিক লোকটি পুকুরের জল সেচতে পাম্প লাগিয়ে জাল টানাচ্ছেন পুকুরে। আমি ছুটে গিয়ে আগের অভ্যাস মতোন একটা কাতলা মাছ হাতে নিয়ে বাড়ীর দিকে ছুট দিলাম। কয়েক কদম এগিযে যেতেই একটা সাড়াশীর মতো হাত আমার ঘাড় চেপে ধরলো, শুনলাম অকথ্য গালি-……….. বাচ্চা, মাছ দে। মাছটা ফেরত দিয়ে দুচোখে জল নিয়ে মায়ের কাছে গেলাম। আমাদের পুকুরের মাছ নয়, সেদিন দুপুরে খেলাম সুতো দিয়ে দুটুকরো করা ডিমের আর্ধেক।
পুজো শেষ হলো- বাইরে প্রথম শীত। মা নিচের দড়জা আটকে পাখির ছানার মতন আমাদের দুজনকে দুপাশে নিয়ে সদ্য শুয়েছেন। এই সময়েই বাইরের দড়জার কড়া নড়ে উঠলো- বুড়ু বাবু। গম্ভীর কন্ঠের ডাক। না- তাহলে লোকটা বেচে আছে, এটি আমার মায়ের প্রথম কথা। তিনজন ছুটে গেলাম নিচে। দাড়িয়ে আছেন আমাদের বাবা- কমরেড প্রসাদ রায়, কয়েক বছরের জেলবাসের ক্লান্তি স্পর্শ করেনি চশমার কাচের নিচের তার উজ্জল চোখকে। মাঝরাতে আবারো ভাতের হাড়িতে টগবগ শব্দ। নিজের বাবাকে স্পর্শ করার উজ্জল আনন্দ।
ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত
Leave a Reply