শুক্রবার, ২৭ মে ২০২২, ০৮:২৯ পূর্বাহ্ন
অধ্যাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরী
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস। প্রতিবছর এই দিন আমাদের কাছে একই দাবি, গণমুখী শিক্ষানীতির দাবী নিয়ে ঘুরে ঘুরে আসে।প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬২ সালে শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে যে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয় তাকে আমরা শিক্ষা আন্দোলন হিসেবে জানি। সেদিন ছাত্রসমাজ গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল করে একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনেরও দাবি জানিয়েছিলেন।১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সংঘটিত ঘটনাবলীর মধ্যে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সাড়া জাগানো “শিক্ষা আন্দোলন” শিক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবেও ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে।
সামরিক আইন জারি করে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান যে দমন-পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণ মূলক আইন, অধ্যাদেশ জারি করে রাজনীতিকদের অযোগ্য ও নিরুৎসাহিত করার হীন প্রচেষ্টা চালায়।তাতে পাকিস্তানে বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে এক চরম রাজনৈতিক শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন সেই রাজনৈতিক শূণ্যতা ভেঙ্গে নেতা কর্মী ও জনগণকে জাগিয়ে তোলে।
ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত, হানাহানি তথা রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম দুর্বলতা এক দশকেরও অধিক সময়কালে এতোই প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করা হলেও এর বিরুদ্ধে জনগণের কোন কার্যকর প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় হতাশ ও ক্লান্ত জনগণ বরং আইয়ুব খানের কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আইয়ুবের স্বৈরাচারী সামরিক শাসন ও এর প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্বিকার জনগণ তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা করতে পারেনি। কিন্তু শিক্ষা আন্দোলন তাদের সেই মোহ ভেঙে দেয়।
শরীফ কমিশন নামে খ্যাত এসএম শরীফের নেতৃত্বে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের ২ মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। গঠিত এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল তাকে সবাই শিক্ষা সংকোচনের নীতি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থ বরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। ৫ বছরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ৩ বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং ২ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিক শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ শতকরা ৭০ নম্বর। এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল যা মারাত্বক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারত।
ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র লীগ, ছাত্র শক্তি ও এন এস এফ আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিরাট ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ।সেখানে ২৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী মিছিল সহকারে যোগদান করে। এরপর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট বড় সমাবেশ অব্যাহত ছিল। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হন। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে- এ কথা শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাধা দেয়। তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গনি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে। এতে ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা ও বাবুল তিনজন নিহত হয়। ওই দিন সারাদেশে মিছিলে পুলিশ গুলি করে। টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশের গুলিতে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিকেরও হত্যার খবর পাওয়া যায়।
পরে ঐ শিক্ষা রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়।
এ সময়কার আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের কাজী জাফর আহমদ, মোহাম্মদ ফরহাদ, আনোয়ার জাহিদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, আব্দুর রহিম আজাদ,আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, মোস্তফা জামাল হায়দার, কাজী ফারুক আহমেদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী, সাইফুদ্দিন মানিক প্রমুখ। আর ছাত্রলীগের পক্ষে যারা সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা হচ্ছেন শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, ওবায়দুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, আসমত আলী সিকদার প্রমূখ। ছাত্রশক্তির নেতাদের মধ্যে ছিলেন মওদুদ আহমদ, মিজানুর রহমান শেলী ও মোঃ আব্দুল হালিম প্রমুখ, এন এস এফ এর পক্ষে আবুল হাসনাত সহ অন্যান্য। তবে সেই সময় কাজী জাফরের আহমেদের অনলবর্ষী বাগ্মীতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, দৃঢ়তা ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে অন্যদের থেকে এগিয়ে গিয়েছিল।
১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন পরবর্তীতে ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলার মুক্তির সংগ্রামে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল ।তেমনি সেই সময় উঠে আসা নেতারাও বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ওই সমস্ত আন্দোলনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
বর্তমানে আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা অর্জন করেছি যদিও সেটা এখনো গণমুখী নয়।
এ ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা করা দরকার ।তবু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কিছু ত্রুটির কিঞ্চিত আলোচনা আজকের এই লেখায় উপস্থাপন করতে চাই কারণ এই স্বল্প পরিসরে বিশদভাবে আলোচনা করার সুযোগ নেই। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা যেটা লক্ষ্য করছি সেটা হচ্ছে লেখাপড়া কমপ্লিট প্রাইভেট টিউশন এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেটা সেদিনের আন্দোলনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আজকের শিক্ষা পদ্ধতিতে অর্থ প্রধান ভূমিকা পালন করছে। যারা আর্থিকভাবে দুর্বল তারা আজকের শিক্ষা লাভে ব্যর্থ হচ্ছে ।আমরা লক্ষ্য করেছি বর্তমানে অনেক স্কুলে বা কলেজে সত্যিকার অর্থে লেখাপড়া হয় না ।শিক্ষক যে সমস্ত লেকচার দেন সেটা ছাত্র-ছাত্রীদের বোধগম্য হয় না।কারণ হচ্ছে শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা, ছাত্র ও শিক্ষক এর আনুপাতিক হার ভারসাম্যহীন ।আমরা লক্ষ্য করেছি অনেক ক্লাসে ৫০থেকে ১০০ জন পর্যন্ত ছাত্র থাকে । সেকারণে কোন মতেই একজন শিক্ষক এত ছাত্রকে পাঠদান করতে সমর্থ হয় না। যার কারণে ছাত্ররা প্রাইভেট টিউশনি তে অংশগ্রহণ করে। যারা প্রাইভেট পড়তে পারে না তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে না। পরীক্ষায় তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে অনেক সময় কোচিং বা টিউশন বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা সফল হয়নি। এক্ষেত্রে সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে ক্লাসে ছাত্র এবং শিক্ষক এর আনুপাতিক হার ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। আন্তর্জাতিক মান সম্মত ভাবে শিক্ষক এবং ছাত্রীর অনুপাত ঠিক করতে হবে ।এজন্য আরো অনেক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে এবং স্কুল-কলেজে আরো অনেক কক্ষের ব্যাবস্থা করতে হবে । স্কুল-কলেজের শিক্ষকের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে কোচিং সেন্টার খুলে বসেছে তাদের অর্থ আয়ের লক্ষ্যে। স্কুল কলেজের শিক্ষকদের টিউশনি করা বন্ধ করে ক্লাসে পাঠদানে সর্বাত্মক মনযোগী হতে হবে।শ্রেণী কক্ষেই লেখাপড়ার বেশিরভাগ সমাপ্ত করতে হবে। একই সঙ্গে কোচিং সেন্টারে যারা শিক্ষক আছেন জরীপ করে তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কোন সুযোগ সৃষ্টি করা যায় কিনা এটা ভেবে দেখতে হবে।তাহলে শিক্ষা সবার জন্য হবে এবং শিক্ষার মান উন্নত হবে অন্যথায় কোচিং সেন্টার নির্ভর শিক্ষা আমাদের জাতির কল্যাণ আনতে পারবে না।
শিক্ষা দিবসে সংশ্লিষ্ট সবার কাছ এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ ও সমাজ কর্মী।
Leave a Reply