সোমবার, ০৪ জুলাই ২০২২, ১২:৫২ পূর্বাহ্ন
ঝুঁকি নিয়েই মানবতাবোধ থেকে ভারতীয় জেলে রবীন্দ্রনাথ দাস কানুকে উদ্ধার করে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রংশসিত হয়েছেন কেএসআরএম গ্রæপের জাহাজ এমভি জাওয়াদের নাবিকরা। ৫ই জুলাই শুক্রবার রাতে ‘এফ বি নয়ন-১’ নামে ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে বের হন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কানু । কানু ছিলেন ট্রলারের মাঝি , সঙ্গে ছিল ১৫ জন জেলে। ৬ই জুলাই শনিবার রাতে ঝড়ের কবলে পড়ে ওই ট্রলার। তখন ভারতীয় জলসীমায় ছিল। হঠাৎ সিগন্যাল দেওয়াতে তারা ভারত উপকূলে পৌঁছাতে পারিনি। একসময় উত্তাল সাগরে মাছ ধরার ট্রলারটি ডুবে যায় , প্রায় সপ্তাহ ধরে পানিতে ভাসতে থাকা ওই ভারতীয় জেলে কানু বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে পড়েন। সাগরে ভেসে থাকতে দেখে জাহাজের মাস্টারকে জানান। তিনি সঙ্গে সঙ্গে কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশ নেভি এবং পোর্টকে খুদে বার্তা পাঠিয়ে বিষয়টি জানান। তবে খারাপ আবহাওয়ার কারণে নেভি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা দ্রুত আসতে পারবে না বলে জানায়। ১০ই জুলাই বুধবার সকাল ১১টার বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই কুতুবদিয়ার অদূরে ভেসে আসা ওই জেলেকে উদ্ধার করেন কেএসআরএম গ্রæপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাওয়াদের নাবিকরা। মুমূর্ষু ও আতঙ্কিত কানুকে জাহাজে থাকা চিকিৎসক দিয়ে দ্রæত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে পুষ্টিকর খাবার ও প্রয়োজনীয় পোশাক দেন জাওয়াদের নাবিকরা।
মহিউদ্দীন চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি বলেন, কেএসআরএম গ্রæপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেড ঝুকিঁ নিয়ে এই জেলেকে উদ্ধার করাই বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। আবারও প্রমান হল আমরা কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয় না,নিজের জীবনের ঝুকিঁ অন্যের জীবন নিরাপদ করি। এমন কাজটির করার জন্যে এসআর শিপিং লিমিটেডকে ধন্যাবাদ।
রবীন্দ্রনাথ দাস কানু সাংবাদিকদের জানান, গভীর সাগরের ভারতীয় অংশে মাছ ধরতে গিয়ে খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়ে তাঁদের ট্রলারটি । শনিবার সকালে উত্তাল ঢেউয়ের মুখে পড়ে হঠাৎ ট্রলারটি উল্টে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়ার পর ট্রলারের ১৫ জনের সবাই বাঁশ ও ভাসমান সরঞ্জাম ধরে আড়াই দিনের মতো ভেসে ছিলেন। এরপর ঢেউয়ের কারণে সবাই আলাদা হয়ে যান। তিনি বাঁশ ধরে ভেসে ছিলেন। ‘যখন বৃষ্টি হতো, হা করে পান করতাম। বৃষ্টির পানি পান করেই বেঁচে ছিলাম। ঘুমাইনি। চোখ বন্ধ করলেই বাবা-মা, ছেলে-মেয়ের মুখটি ভেসে উঠছিল। ‘উনারা আমার জন্য যে কষ্ট করেছেন, জাহাজটা যেভাবে ঘুরিয়েছেন সে জন্য আমি এখনো বেঁচে আছি। নয়তো আমি কখন চলে যেতাম।’ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি এ জাহাজ কোম্পানিকে যেন আরও বড় করে।’ শেষ পর্যন্ত নিজেকে উদ্ধার করার জন্য এমভি জাওয়াদের নাবিক, কেএসআরএম গ্রুপ, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
এমভি জাওয়াদের ক্যাপ্টেন এস এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, ভারত থেকে ক্লিংকার নিয়ে তাঁরা চট্টগ্রাম বন্দরে ফিরছিলেন। বুধবার সকালে বন্দর সীমানার বাইরে কুতুবদিয়ায় একজনকে ভাসতে দেখেন তাঁরা। নিশ্চিত হওয়ার পর কেএসআরএম গ্রুপের কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন তাঁরা। এ সময় কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীকেও জানানো হয়। অনুমতি আদায় করার পর প্ল্যান মোতাবেক আমরা জাহাজ ঘুরিয়ে সে যেদিকে ভেসে গেছে, সেই দিকে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ চলার পর দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে আমরা তাকে অনেক দূরে দেখতে পাই।জীবিত একজন মানুষ উত্তাল সমুদ্রে আমাদের চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে। আর আমরা তাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করবো না,সেটা হতে পারে না। শুধু এই মানবিকবোধ থেকেই আমরা ভারতীয় জেলে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নেই এবং উত্তাল সমুদ্রে ঝুঁকি নিয়ে তাকে উদ্ধার করি। যদি আমরা তাকে উদ্ধার না করতে পারতাম, তাহলে এই আফসোস সারাজীবন থেকে যেতো। এ কারণে আমরা শান্তিও পেতাম না।
জাহাজের চিফ অফিসার প্রিয়তোষ চৌধুরী বলেন, ‘সাগরে ভেসে থাকায় তার (রবীন্দ্রনাথ) শরীরের তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রির নিচে নেমে যায়। তখন আমরা তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য কম্বল দিয়ে তাকে মুড়িয়ে দেই। এরপর তার শরীরে গরম পানির ছিটা দেই, সরিষার তেল গরম করে মালিশ করি। ডাক্তারের পরামর্শে জাহাজে থাকা বিভিন্ন ওষুধ, ইনজেকশন পুশ করার পর দেখলাম, সে দ্রæত রিকভারি করতে লাগলো। এরপর সে ঘণ্টা চারেক ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে তার খালাতো ভাইয়ের একটা নম্বর দিয়ে ওই নম্বরে কল দেয় এবং জানায় যে সে বেঁচে আছে। আমরাও তার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। এরপর সে তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমরা তাকে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেই। প্রায় ২০ মিনিট সে তার মা, বাবা, ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে। এরপর সে আবার হোয়াটসঅ্যাপে তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলে।’
কেএসআরএম গ্রুপের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান জানান, মেরিটাইম ওয়ার্ল্ডের বিধান অনুযায়ী বৈরী আবহাওয়ায় ডুবে যাওয়া ট্রলারের জেলেকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে আমাদের জাহাজের লোকজন। আমাদের জাহাজের মাস্টার ও তাঁর টিম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিষয়টিতে সামাল দিয়েছেন। আমরা বিষয়টি জানার পর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত তদারক করছি প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে। বিষয়টিকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছি।
১২ জুলাই শুক্রবার বিকালে রবীন্দ্রনাথ কানুকে কোষ্ট গার্ড কার্যালয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে পতেঙ্গা থানার কাছে হস্তান্তর করা হয়। শনিবার দুপুওে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একপি ফ্লাইটে তাকে কলকাতা পাঠানো হয়েছে।সেখান থেকে বাড়ী পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে কাকদ্বীপ সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের চিকিৎসাধীন আছেন।
Leave a Reply