মঙ্গলবার, ০৫ জুলাই ২০২২, ১২:৪৪ অপরাহ্ন
পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং মধুর সম্পর্কগুলোর মধ্যে সন্তান ও বাবা-মায়ের সম্পর্কগুলো অন্যতম। যেখানে সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা থাকে নিখাদ ও স্বার্থহীন। অপরদিকে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসায় থাকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আর এসবের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে সন্তান ও বাবা-মায়ের মজবুত একটি সম্পর্ক। আর সে সম্পর্কগুলোই অটুট থাকে জীবনাবসান অবধি।
শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিন সন্তানদের নিয়ে একসাথে বসে খাওয়ার চেষ্টা করবেন। সকালে না পারলেও অন্ততপক্ষে রাতের খাবারটা একসাথে খেতে বসুন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারের সবাই একসাথে বসে খাবার খেলে সন্তানাদের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, শক্তিশালী মানসিকতা, উন্নত আচরণ, সামাজিক দক্ষতা ও একাডেমিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ছোটবেলায় প্রায় প্রতিটি সন্তানেরই খাওয়ার প্রতি একটু অনীহা দেখা দেয়। তাই পরিবারের সবাইকে একসাথে নিয়ে খেতে বসুন। দেখবেন সবার দেখাদেখি আপনার শিশু সন্তানটিও খেতে থাকবে। কারণ শিশুরা সাধারণত অনুকরণপ্রিয় হয়ে থাকে। এছাড়াও, মাঝে-মধ্যে আপনি নিজ হাতে আপনার সন্তানদের খাইয়ে দিতে পারেন। ছেলে-মেয়েরা যতো বড়ই হোকনা কেন; তারা বাবা-মায়ের হাতে খাবার খেতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ও ভালোবাসে। এতে করে সন্তানের সাথে আপনার অকৃত্রিম সম্পর্কটি আরোও দৃঢ়ভাবে ফুটে উঠবে। আরও মজবুত হবে স্বার্থহীন সম্পর্কগুলো।
আপনার সন্তানের সাথে এমন একটি সম্পর্ক গড়ে তুলুন যেন একে-অপরকে নির্দ্বিধায় সব কথা বলতে ও বুঝাতে পারেন। এক্ষেত্রে সবথেকে ভালো সুযোগ ও সময় হলো রাতের খাবারের সময় অথবা ঘুমানোর আগ মুহূর্তে তাদের সাথে কথা বলা। আপনার প্রতিদিনের কার্যকলাপ সম্পর্কে পরিবারের সবার সাথে আলোচনা করুন। যেমন- আজ আপনি কয়টি ভালো কাজ করেছেন, আজ আপনার সবচেয়ে বড় অর্জনটা কী ছিলো, আজ আপনি কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং সে সমস্যা গুলো কীভাবে সমাধান করেছেন? ঠিক একই ভাবে তার কাছেও জানার চেষ্টা করুন- সে আজ কয়টি ভালো কাজ করেছে, কয়টি খারাপ কাজ করেছে, তার আজকের সবচেয়ে ভালো সময়টা কী ছিলো, আজ সে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলো, সেগুলো সমাধান করতে পেরেছে কিনা, না পারলে ঐ সমস্যা গুলোর সমাধান কীভাবে করা যেত ইত্যাদি।
মোটকথা এসব প্রতিদিনকার খুঁটিনাটি বিষয় গুলো সম্পর্কে আলোচনা করুন। যা আপনার সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন অল্প অল্প করে নতুন কিছু শিখবে আপনার কাছ থেকে। আপনার মতো করেই জীবন যুদ্ধে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে একজন সেরা সৈনিক হিসেবে এবং তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সম্পর্ক মজবুত করতে আরেকটি সর্বোত্তম পন্থা হলো বিনোদন অথবা যেকোনো মাধ্যমে তাদেরকে সময় দেওয়া। বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তাদের সাথে ঘরে অথবা বাইরে খেলাধুলা করুন এবং অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলাধুলা করতে দিন। তাদেরকে সাথে নিয়ে বই পড়ুন, ছবি আকুঁন। তাদের নিয়ে একসাথে বসে টিভি দেখুন। বেশি সময় হাতে পেলে তাদের নিয়ে বনভোজনে যান অথবা রোমাঞ্চকর কোনো জায়গায় ভ্রমণ করে আসুন।
ব্যস্ততার মাঝেও অন্ততপক্ষে সপ্তাহে একদিন সময় দিন। এতে করে তারা ধীরে ধীরে বাইরের পরিবেশের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে শিখবে এবং তাদের সাথে কাটানো সময়টুকু আপনাদের মাঝে মায়ার সঞ্চার করবে যা আপনাদের সম্পর্ক মজবুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পৃথিবীতে সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হলো মায়ের কোল এবং সবচেয়ে সাহস জোগায় যখন সন্তানের কাঁধে বাবার হাতটি থাকে। তাই আপনার সন্তানকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিন, খারাপ সময়গুলোতে তাদের অভয় দিন, সামনে এগিয়ে যাবার জন্য তাকে উৎসাহ প্রদান করুন। সন্তানদের সাথে সম্পর্কটা এমনই হওয়া উচিত, যেন তারা আপনার কাছে আসতে ভয় না পায়। তাদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলুন যেন আদর-স্নেহ ভালবাসার কমতি না থাকে। এতে করে আপনার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে এবং সম্পর্ক হবে আরো মজবুত।
একটি শিশু তার প্রাথমিক শিক্ষাটা বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পেয়ে থাকে। বাবা-মা হচ্ছেন সন্তানদের প্রথম শিক্ষক। তাই আপনাকে তাদের প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনতে হবে এবং মূল্যায়ন করতে হবে। এতে করে দেখবেন তারাও আপনার কথাগুলো শুনবে ও মূল্যায়ন করার চেষ্টা করবে। শিশুকে শিশু না ভেবে একজন মানুষ হিসেবে গণ্য করুন। তাদেরকে কথা বলার সুযোগ দিন, প্রতিটি মতামতকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করুন এবং তাদের চিন্তাধারাগুলোকে তাদের অবস্থান থেকে উপলব্ধি করে পছন্দ-অপছন্দগুলোকে মূল্যায়ন করুন। এতে করে আপনার সন্তানরাও বুঝবে যে তারা আপনার পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং তাদের মতামতেরও মূল্য আছে। যা পরিবারের প্রতি আপনার সন্তানদের দায়িত্ববোধ ও অন্যান্যদের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে সাহায্য করবে।
তারা অবুঝ, যেকোনো কাজে তাদের ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে বকাঝকা না করে, ভয় না দেখিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিন। পুনরায় চেষ্টা করতে বলুন ও উৎসাহ প্রদান করুন। এসবই তাকে সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে এবং বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক অটুট করতে সহায়তা করবে।
শিশুরা স্বাভাবিক ভাবেই অনুকরণপ্রিয়। তারা উৎসাহ নিয়েই নতুন কোনো কাজ করতে পছন্দ করে এবং অন্যদের সাহায্য করতে ভালবাসে। তাই ছোট থেকেই তাদেরকে দায়িত্ব সহকারে কাজ করতে শেখান। নিজের টুকিটাকি কাজগুলো নিজেকে সম্পন্ন করার তাগিদ দিন। যেমন- খেলা শেষে খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখা, পড়ার টেবিলের বই-খাতাগুলো সাজিয়ে রাখা, স্কুলব্যাগ গুছানো, জুতার ফিতা বাঁধা; এভাবে ছোট থেকেই কাজের উৎসাহ প্রদান করুন। ব্যর্থ হলে বারবার শিখিয়ে দিন এবং আপনি নিজেও তাদের কাজে সাহায্য করুন। আস্তে আস্তে তারা নিজের কাজগুলোকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলবে। এবং একটা সময় যেকোনো কাজের প্রতি নিজ উদ্যোগে দায়িত্বশীল ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। এভাবেই পরিবার ও পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি তাদের অগাধ ভালোবাসার সঞ্চার হবে।
সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ভালবাসার কোনো বিকল্প নেই। এ পৃথিবীতে ভালবাসা ছাড়া সবই মূল্যহীন। প্রত্যেক সন্তানকেই সমান চোখে দেখতে হবে এবং সন্তানদের সাথে সম্পর্কের বন্ধন মজবুত করতে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ করাটাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ তারা ছোট; আপনার অপ্রকাশিত ভালবাসাগুলো তারা উপলব্ধি করতে পারবে না। তাই প্রতিদিন আপনার সন্তানদের জন্য এমন কিছু করুন যাতে করে তারা আপনার ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে। আপনি তাদেরকে কতোটা ভালবাসেন, তারা আপনার কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ- তা প্রতিদিন ছোট ছোট কিছু কাজের মাধ্যমে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করুন।
বলছিনা কেবলই ভালোবাসুন, কারণ আদরের পাশাপাশি প্রয়োজনের সময়ে সঠিক মাত্রার শাসনটাও জরুরি। কিন্তু তা যেন এমন মাত্রায় না হয়ে যায় যেখানে আপনার সন্তানরাই আপনাকে তাদের অপ্রিয় মানুষদের লিস্টে সংযোজন করে বসে! যদি কখনো তাদের সাথে রাগারাগি হয়, তখন চেষ্টা করুন রাগকে নিয়ন্ত্রণ রাখার এবং তাদেরকে সুন্দর ভাষায় বুঝিয়ে বলার। মাঝেমাঝে বাইরে থেকে তাদের প্রিয় কোনো খাবার কিংবা উপহার নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দিতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে তাদেরকে কাছে টেনে বুঝিয়ে বলুন আপনি তাদের কতোটা ভালোবাসেন এবং পরিবারে তাদের অবদান কেমন হওয়া উচিত। ভালোবাসা কেবল কাজে প্রকাশ করলেই হয় না, মুখে এবং আচার-আচরণের মাধ্যমেও বুঝাতে হবে। আর এভাবেই আপনাদের সম্পর্কটা হয়ে উঠবে মজবুত।
মাত্র কয়েকটি অভ্যাস পাল্টানোর ফলে যদি সন্তানদের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন, তাহলে তা হবে অর্থকড়ির চাইতেও অনেক বেশি মূল্যবান। হয়তো আমাদের কারোরই কোনো সুপার পাওয়ার নেই কিন্তু নিজের সন্তানের কাছে কে না হতে চায় সুপার ড্যাড কিংবা সুপার মম? আসুন না, ভালো কিছু অভ্যাসের মাধ্যমে নিজেকে একটু পরিবর্তন করে সন্তানের কাছে তাদের আইডল হিসেবে পরিচিত হই! নিজের সন্তানদের কাছে নিজেকে পরিচিত করি পৃথিবীর সেরা বাবা কিংবা মা হিসেবে!
Leave a Reply